শ্রীলঙ্কানদের চোখে বাংলাদেশ:সাদরুল আহমেদ খান
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:৩৯:৫৪,অপরাহ্ন ১১ মে ২০২২
রিয়েলটাইমস৭১ ডেস্ক :: ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সাথে শ্রীলঙ্কা যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেই সুবাদে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের গবেষক সাগিসব্রা সেনাধ্রার সাথে পরিচয় হয়। সম্প্রতি এই গবেষক শ্রীলঙ্কার সিলন টুডে পত্রিকায় বাংলাদেশ শ্রীলংকার অর্থনীতির সমীক্ষা করে একটি কলাম লিখেছেন, যার কপি তিনি আমাকে পাঠিয়াছেন । পাঠকদের জন্য সেই কলামের কিছু অংশ তুলে ধরলাম । প্রসঙ্গত শ্রীলঙ্কাকে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা এবং ২০ কোটি টাকার ঔষধ সহায়তা প্রদান করে অকৃত্রিম বন্ধুত্বের স্বাক্ষর রেখেছে ।
সাগিসব্রা সেনাধ্রা লিখেছেন, শ্রীলঙ্কা এখন এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজস্ব ঘাটতিজনিত সংকট মোকাবিলা করছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাকে কিছু গাইডলাইন দিয়েছে; তবে আঞ্চলিক অভিজ্ঞতা থেকেও শ্রীলঙ্কা তার এ সমস্যার একটা সমাধান পেতে পারে, আর সেটা হলো বাংলাদেশ ।
শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের সাফল্যগাথা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ব্যাপারে বাংলাদেশ একটা দারুণ নজির তৈরি করেছে। গত ১০ বছরে (২০১০-২০২০) দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল অর্থনীতিগুলোর একটি বলে পরিচিতি পেয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে দেশটির জনসংখ্যার বোনাস কাল (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড), তেজি তৈরি পোশাক খাতনির্ভর রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতির কারণে।
করোনা মহামারির আগেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি ছিল- ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশটি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যেখানে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ‘বিস্ময়কর ধাঁধা’ বলে উল্লেখ করেছে।
শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও করোনাকালে নিম্নমুখী প্রবণতার শিকার হয়েছিল; কিন্তু উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার কল্যাণে দ্রুতই তা ঘুরে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। দৈনিক মাথাপিছু আয় বেড়েছে, মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকেও দেশটি ব্যাপক উন্নতি করেছে।
নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান যেখানে অর্থনীতি সামলাতে খাবি খাচ্ছে; বাংলাদেশ সেখানে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটা মডেল স্থাপন করেছে। মেগা প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যাপারে বাংলাদেশ চাইলে এখন গর্ব করতে পারে। সেখানে গ্রামাঞ্চলে নগরের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কাজ চলছে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় উড়াল সড়ক দেখা যায়। মেট্রোরেলও খুব শিগগির চালু হচ্ছে। প্রমত্ত পদ্মার ওপর নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বিশাল দৈর্ঘ্যের সেতু এখন আর কোনো স্বপ্ন নয়।
বাংলাদেশ সরকার দেশটির অগ্রগতি সাধনে দারুণ প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছে। এ কারণেই দেশটি একেবারে নিঃশঙ্ক চিত্তে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প নিতে পারছে। বর্তমানে সেখানে দেশব্যাপী একশ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। ট্র্যাক রেকর্ড ভালো হওয়ায় দেশটি বেশ ভালো পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগও পাচ্ছে। এটা এখন বলাই যায়, দেশটির অর্থনীতি বেশ মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয় সত্ত্বেও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় প্রায় ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে। আর, শ্রীলঙ্কার আছে মাত্র দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এক ভান্ডার, যার মধ্যে আবার মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার তার হাতে আছে। কাজেই বাংলাদেশ কোনোভাবেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনীয় নয়।
তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ হলো অলৌকিক এক গল্প; আর শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান হলো বিপর্যয়গাথা। পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ এখন ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। একই সঙ্গে মুদ্রাস্ম্ফীতি সেখানে কোনো বাঁধ মানছে না। গত তিন বছর ধরে উন্নয়ন সেখানে থমকে আছে। রুপির ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন, ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার, ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য ও রাজস্ব ঘাটতির কারণে পাকিস্তানের অর্থনীতি ইতোমধ্যে ভঙ্গুর দশায় পড়েছে। শুধু যে পাকিস্তানি রুপির অবমূল্যায়ন ঘটেছে, তা নয়; দেশটির অর্থনীতির চাকা গত তিন বছর ধরে প্রায় অচল হয়ে আছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পোৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা বহু মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এগুলোর মধ্যে আছে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, সড়ক ও অন্যান্য প্রকল্প। এ প্রকল্পগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প এখন অপ্রয়োজনীয় ও বাতিল বলে গণ্য হচ্ছে। এসব প্রকল্পের নামে একেক সরকার দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে। তারা তা করেছে অনেকটা বাছবিচারহীনভাবেই। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমশ কমে এসেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, গত ১৫ বছরে শ্রীলঙ্কা একরত্তি পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগও টানতে পারেনি। বিদেশি বিনিয়োগ টানার বদলে সরকারগুলো বরং ঋণ সংগ্রহের ওপর বেশি নজর দিয়েছে।’
তবে বর্তমানে শ্রীলঙ্কা ভারত ও চীনের কাছ থেকে ঋণ পরিশোধের প্রক্রিয়াটি পুনর্বিন্যাসের সুযোগ পেয়েছে; আইএমএফের কাছ থেকেও দেশটি কিছু জরুরি সহায়তা পাচ্ছে। এসব পাওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কার জন্য একটু শ্বাস ফেলার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এ সময়টাতে দেশটি তার অর্থনীতিকে আবার ট্র্যাকে তোলার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের সুযোগ পাবে। তা করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের কাছ থেকে শিখতে পারে- দেশটি তৈরি পোশাকসহ বহু শিল্প ও কৃষিপণ্য রপ্তানি কীভাবে বাড়িয়েছে; একই সঙ্গে কোন প্রক্রিয়ায় এসব খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ টানতে পেরেছে।
প্রিয় পাঠক, এই ছিল একজন শ্রীলঙ্কান বন্ধুর চোখে বাংলাদেশের অবস্থান। আসুন সব গুজব উপেক্ষা করে আমরা সামনেরর পথে এগিয়ে চলি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য আজ সর্বজন স্বীকৃত । ধারাবাহিক উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে, সুবিবেচিত নীতি ও আর্থিক খাতে সংযত আচরণ বাংলাদেশকে এশিয়ান ইমারজিং ইকোনমির দেশ হিসেবে প্রশংশিত করেছে । তাই বাংলাদেশ চলবে আপন গতিতে, আপন বিবেচনায় । মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা দাঁড়াবে মাথা উচু করে ।
লেখকঃ স্কোয়াড্রন লীডার (অবঃ) সাদরুল আহমেদ খান, সদস্য অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ কমিটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ।