আরব আমিরাতে সাত মাস, আব্বার স্মৃতি ও একজন দালালের গল্প;মেহেদী হাসান
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:৫০:২৪,অপরাহ্ন ১৭ নভেম্বর ২০২১
রিয়েলটাইমস ডেস্ক::করোনার প্রাদুর্ভাব ও নিজস্ব ভুল উদ্যোগের কারণে বিগত বছরগুলোতে অনেক টাকা উড়িয়েও মেরুদণ্ড সোজা করে দাড়াতে পারিনি। পড়ালেখা শেষ করে বিয়ে সংসার করে দ্রুত সময়গুলো চলে যাচ্ছিলো। সেই সাথে দায়ীত্ব আর হতাশাবোধ পাহাড়ের ওজন নিয়ে কাঁধে চড়ে বসেছিলো। বাবা ছিলেন মাথার উপর ছায়া হয়ে। যত চেয়েছি, দিয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশী।
ফেব্রুয়ারী ২০২১ এ দুবাই চলে আসে এলাকার ছোট ভাই জুয়েল আহমেদ ওরফে জুয়েল তালুকদার। আসার আগে বলেছিলো দুবাই থেকে পর্তুগাল যাওয়ার কনট্রাক্ট করা তার। বিশ্বাস করেছিলাম তাকে, বলেছিলাম আমাকেও একটা লাইন দে। সব সময় ভেবেছি ইউরোপের কোথাও সেটেল হব। সে বললো আমি যাই আগে পরে তোমার সাথে যোগাযোগ করবো। মার্চের মাঝামাঝি যোগাযোগ করে চুপচাপ কথা দিয়ে ফেলি তাকে। দুবাই ভিজিট তো করা যাবে, কাজ আর কাজের ভিসা কে দিবে? তুই পারবি কিছু একটা ঠিক করে দিতে? সে বললো কোনো সমস্যা নাই তবে টাকা লাগবে। বললাম টাকা লাগলে দিব। পরে কয়েকদিন বেশ খোঁজ খবর নিয়ে, ভেবে চিন্তে জুয়েলকে জিজ্ঞেস করলাম কী কাজ দিতে পারবি? আমার সাথে সুট করবে এমন কাজ চাই। সে বললো সুপারমার্কেটে করতে চাইলে দুই লাখ সত্তুর হাজার আর ট্রাভেলস কোম্পানিতে করতে চাইলে তিন লাখ তিরিশ হাজার লাগবে সব খরচ মিলিয়ে। বললাম ওকে, ভিজিট বের করে দে। আগে আসি, আসার পরে সব বুঝে টাকা দিব? সে বললো, না, কিছু টাকা আগে বায়না দিতে হবে। বললাম ঠিকাছে, টাকা দিব। এখনো ঘরে কথা বলিনি, কাল কথা বলে তোকে ফাইনাল করবো। পরের দিন থেকে সকাল বিকাল আলাতুল ফোন মেসেজ জুয়েলের ইরানি মুদিরের সাথে তার কনট্রাক্ট হয়ে গেছে আমার এমপ্লয়মেন্টের জন্য অলরেডি সে তার পকেট থেকে দুই হাজার দেরহাম (টাকায় যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা) দিয়ে দিয়েছে। এর আগেই সে জমা দেয়ার জন্য আমার সব কাগজপত্রের কপি দিয়ে দিয়েছিলাম। আমি অকপটে তাকে বিশ্বাস করেছি। কিন্তু খটকা তখন লেগেছে যখন বললো সত্তুর হাজার টাকা পাঠাও জলদি। ঘরে আলাপ করলাম, কী করবো। তারা বললেন আমার শ্বশুর ও ভায়রা প্রবাসী তাদের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নাও। তাদের সাথে আলাপ করলাম। ভায়রা রফিক উদ্দিন ভাই তখন দেশে, শ্বশুর আব্বা আবু ধাবি। তারা নিজে কথা বললেন জুয়েলের সাথে। কথা বলে পরামর্শ দিলেন আল্লাহর নামে পা বাড়াও। জুয়েলকে বললাম এভাবে টাকা লেনদেন কী করে হয়। একজন গ্রান্টারের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করি। সে বললো ঠিকাছে ডাক্তার হান্নান ভাইয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করি।
পরে হান্নান ভাই ও জুড়ী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রিংকু রঞ্জন দাশ দাদার সাথে কথা বলে জুয়েলকে ৭০ হাজার টাকা পাঠাই। সে পরের দিনই আমার আরব আমিরাতে যাবার ভিজিট ভিসা বের করে। আমাকে বলে দুই দিনের মধ্যে অমুক ট্রাভেলসে টিকেটিংয়ের জন্য ১ লাখ টাকা জমা দাও। আমি সাথে সাথে যোগাযোগ করে ঐ ট্রাভেলসে ১ লাখ টাকা দিয়ে দিলাম। সাথে ডলার এনডর্স করার জন্য আরো ৫৫ হাজার টাকা দিলাম। ঠিক হলো ৮ দিন পরে এপ্রিল ৮ তারিখে আমার ফ্লাইট। করোনার লকডাউনের কারণে ৩ তারিখ রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে বের হই। এদিকে জুয়েল ফোনের পর ফোন, মেসেজের পর মেসেজ করছে ফ্লাইটের আগেই কন্ট্রাক্টের ৩ লাখ ত্রিশ হাজার টাকার বাকী ১ লাখ টাকা ব্যংক মারফত পাঠিয়ে দিতে। বলে টাকা না দিলে এজেন্ট এয়ারপোর্টে আসবে না আমাকে নিতে। আমি ঢাকায়, ওদিকে আব্বা দৌড় ঝাপ করে আমার ফ্লাইটের আগের দিন বাকী ১ লাখ টাকা জুয়েলকে পাঠিয়ে দিলেন। জুয়েল তখন আবু ধাবিতে ছিলো তার ভিসা লাগানোর কাজে। ৮ তারিখ সে আমাকে রিসিভ করতে দুবাই আসবে, সেখান থেকে কথামতো আমাকে আজমানে নিয়ে আসবে। লেনদেন শেষ, এখন ভালোয় ভালোয় দুবাই পৌছে কাজ শুরু করে ভিসা লাগানোর পালা। ৮ এপ্রিল ২০২১ সন্ধ্যায় আমি দুবাই এএয়ারপোর্ট পৌছালাম। ওখান থেকে এক বাঙ্গালী ভাইয়ের ফোন থেকে ওকে ফোন করে প্রায় ঘন্টাখানিক অপেক্ষা করলাম। সে আসলো, একা। কোনো এজেন্ট তার সাথে নেই। আমি জানতাম সেই এজেন্ট। আর আমার পাঠানো টাকা দিয়েই সে আবু ধাবি গিয়ে অন্য দালালের কাছ থেকে তার নিজের এমপ্লয়মেন্ট ভিসা লাগিয়ে এসেছে।
দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আজমান শহরের দিকে রওনা হই। ট্যাক্সিতে বসে জুয়েলের ফোন থেকে বাসায় ফোন করে জানাই ঠিকমত পৌঁছেছি। আজমানে এসে একটি লেবার ক্যাম্পে সিট ভাড়া করে দেয় সে। যেখানে তার নিজেরও সিট ছিলো। রুমে এসে বিছানায় শুয়ে সব কিছু ভেবে অনেক সময় কান্না করলাম। তারপর উঠে ওর সাথে গিয়ে একটা বাঙালি হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে আসলাম। রুমে এসেই জুয়েল আমাকে বললো পাসপোর্ট এবং বাকী টাকা দিতে, অর্থাৎ নিজে খরচ করার জন্য যে ৫৫ হাজার টাকা ডলার বানিয়ে এনেছিলাম। আমি সাথে সাথে দিয়ে দিলাম। কারণ তাকে বিশ্বাস করেই তার সাথে লেনদেন করেছি। এখন পেছন ফেরার কোনো পথ নেই, যা হবার হবে। সে বললো যাও ঘুমাও, সকালে তোমাকে নিয়ে কয়েক জায়গায় যাবো যেখানে তোমার জন্য বায়না করে রেখেছি। তোমার যেটা পছন্দ হবে করবে। সে বলেছিলো একটি ট্রাভেলস কোম্পানিতে অফিস জবের জন্য একজনকে টাকা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু সে আমাকে সেই ট্রাভেলসের অফিসে কখনো নিয়ে যায় নি। বললো কয়েকদিন আশেপাশের সুপার মার্কেটগুলোয় দেখি, কারণ ওগুলোতে ভ্যাকেন্সি বেশী, ভিসা লাগায় তাড়াতাড়ি, আর স্যালারিও বেশী। যদি না হয় তবে তোমার জন্য যেখানে ঠিক করে রেখেছি সেখানে নিয়ে যাবো। আমি বললাম, ওকে।
পরের দিন থেকে আশে পাশের সবগুলো মল, শপ, সুপার শপগুলোতে সিভি ড্রপ করলাম। ম্যানেজারের সাথে গিয়ে কথা বললাম। সবাই আশ্বাস দিলো যে ওরা যোগাযোগ করবে। ৯,১০,১১ এই তিন দিনে অনেক জায়গায় হাটলাম, এবং প্রতিদিনই এখানকার সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় শপ আলফান ইমারতে সিভি নিয়ে গেলাম। ইরানি ম্যানেজার আব্দুল কারিম বললেন আমি রোজ রোজ কেন আসছি, যদি দরকার হয় সিভি আছে ওরা যোগাযোগ করবেন। আমি বললাম স্যার প্লিজ আমাকে একটা সুযোগ দিন, আমি ইংলিশ জানি, হিন্দি জানি, কম্পিউটার জানি, আমি একজন এডুকেটেড পার্সন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওকে কাল সকালে আসো, একটি সুযোগ দেব, দ্বিতীয়টি দেব না। পরের দিন সকালে এসে কাজে জয়েন করলাম। পুরোদিন কিচেন সেকশনে কাজ করলাম। সকাল দশটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ডিউটি। মাঝে তিন ঘন্টা ব্রেক। পরের দিন ২০২১ সালের পবিত্র মাহে রমাদান শুরু হলো। ওদিন আমাকে সেকশন থেকে কাউন্টারে পাঠিয়ে দেয়া হলো। পুরো শপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কাউন্টারে। ফটকের দুপাশে এমাথা-ওমাথা লম্বা ১৩টি কাউন্টার। একটিতে রিটার্ন, বাকীগুলোতে সেল। আমাকে কয়েকদিনের জন্য অন্যের সাথে দেয়া হলো কাজ শেখার জন্য। সপ্তাহ খানিক পর আমি নিজস্ব সিস্টেম দেয়া হলো, সেই সাথে আমি আল ফান ইমারতে ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচয় পেলাম।
রোজার শেষে ওই মাসে আমি ১৮ দিনের স্যালারি পেলাম। সেখান থেকে আব্বাকে মাত্র ছয় হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম। আমার প্রবাসের প্রথম রোজগারের টাকা পেয়ে আব্বা বাসায় কয়েকজন ইয়াতিম মাদ্রাসা ছাত্র ও হুজুর ডেকে দোয়া পড়ালেন। এখানে বিনা আইডি লোক মোবাইল সিম কিনতে পারে না। সিম ছাড়া দেশে যোগাযোগ একমাত্র ওয়াইফাই নেট দিয়ে। আবু ধাবি প্রবাসী আমার শ্বশুর আজমানে বসবাসরত ওনার চাচাতো ভাই জুবের আহমেদ চাচাকে বলে আমার জন্য একটি সিমের ব্যবস্থা করে দিলেন। জুবের চাচা ওনার আইডি দিয়ে সিম কিনে নিজে গাড়ি চালিয়ে এসে জুয়েলকে সেটি দিয়ে গেলেন। নাম্বার পাওয়ার পর আব্বা সরাসরি কল করতেন আমার ফোনে। দেশ থেকে কল করলে অনেক টাকা মিনিট কাটে, এমনকি প্রতিটি কল রিসিভ হোক না হোক ঢুকতেই ৫ টাকা চার্জ কেটে যায়। ডিউটির চাপে সময়মত ফোন না করলে আব্বা একটানা দশ-পনেরোটি কল দিতেন। আমাকে বিদেশ দিয়ে অনেক প্রশান্তি পেয়েছিলেন। ২৯ বছর পর্যন্ত আমাকে সামনে এগিয়ে দিতে চেষ্টার কোনো কমতি করেন নি আলহামদুলিল্লাহ। শুধু আমার কাগজপত্র ভিসা এসব নিয়ে টেনশন করতেন। ফোন করলেই জিজ্ঞেস করতেন কাগজপত্র সব হবে তো? টাকা পয়সা আরো লাগলে বলিস। আমি ওনাকে নির্ভার করলেও নিজে নির্ভার হতে পারতাম না কারন আমাদের কোম্পানিতে স্টাফদের এমপ্লয়মেন্ট ভিসা হয় দেরীতে। নিজে তিন মাসের এক ভিজিট নিয়ে আসলে আরো এক-দুই ভিজিট লেগে যায় এমপ্লয়মেন্ট হতে হতে। আর এক্সট্রা ভিজিটের টাকা স্টাফদের বেতন থেকে কাটা হয়। আমার ভিসা লাগানোর কথা বলে জুয়েল টাকা নিয়ে অন্য দালালের কাছে নিজের এমপ্লয়মেন্ট করিয়েছে। আমার কাছে সে এটা স্বীকার না করলেও ওর কাজ কর্মে ওঅন্যের সাথে ফোনালাপের কায়দায় প্রথম মাসেই টের পেয়েছি আমার ভিসা লাগানোর টাকা জুয়েল মেরে দিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলে বলতো তোমার ভিসা লাগানোর ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা আমার কাছে আছে। যদি কোম্পানি তোমার ভিসা না লাগিয়ে দেয় আমি লাগিয়ে দেব। যতগুলো ভিজিট লাগবে টাকা আমি দেব। আমি ওকে বিশ্বাস করলাম। রোজা ঈদে যে ১৮ দিনের দিনের বেতন (৯০০ দেরহাম) পেয়েছিলাম সেখান থেকে বাসায় ১০ হাজার টাকা পাঠানোর পর জুয়েল ১০০ দেরহাম নিলো দুদিন পরে দিয়ে দেবে বলে। উল্লেখ্য রোজার সময় আমার হাতে একটি মারাত্মক বিষফোঁড়া উঠেছিলো যেটির চিকিৎসা করতে ৮৫ দেরহাম খরচ দিয়েছিলো সে। কথা দিয়েছিলো এখানে আসার পর আমার একমাসের খাবার ও রুম রেন্ট সে পরিশোধ করবে। আমার একমাসের রুম রেন্ট ২৫০ দেরহামের মাত্র ১০০ দেরহাম এবং হোটেলের খাবার ২৫০ দেরহামের মাত্র ১০০ দেরহাম পরিশোধ করেছিলো সে। বাকী টাকা দিতে সে অস্বীকৃতি জানানোয় রুম ছেড়ে দিব তাই ভেবে বাকী টাকা আমিই পরিশোধ করে জুয়েলের ওখানের রেন্টাল রুম ছেড়ে আমি কোম্পানির একোমোডেশনে চলে আসলাম।
এপ্রিলের ১৬ তারিখ কোম্পানির কয়েকজন নতুন স্টাফদের সাথে নতুন বিল্ডিংয়ে একটি রুম নিলাম। বেড নেই, এসি নেই, শোবার জন্য শুধু একটা কম্বল আর বালিশ। এদেশে এসি ছাড়া রুমে ঘুমানো এক কথায় অসম্ভব। যেদিকে কাত হয়ে শুতাম ওই পাশ ঘামে ভিজে যেত। অথচ এ মাসের বেতন পেতে পেতে সামনের মাসের মাঝামাঝি। আমার কাছে কিছু টাকা থাকলেও ওদের কাছে নেই। বেডিং, এসি এগুলো কিনতে জনপ্রতি ২০০ দেরহাম মতো খরচ আসবে। অতএব সামনে বেতন পাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো উপায় নেই। দুদিন পর পর বাসায় কথা হতো। বাবার চেয়ে মায়ের সাথে কথা বেশী হতো। আব্বা ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করেই মাকে ফোন দিয়ে দিতেন। ভিডিও কলেও সামনে আসতেন না। রোজায় মাত্র একদিন ভিডিও কলে কয়েক মিনিট কথা বলেছিলেন। কে জানতো সেই শেষ দেখা। জুনের ৮ তারিখ সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি আব্বা অনেকগুলো কল দিয়েছেন আমি ডিউটি যাওয়ার সময় ওনাকে কল দিয়ে দুই মিনিট কথা বললাম। জিজ্ঞেস করলেন বেতন কবে পাবি। আমি বললাম আরও সাপ্তাহ দশদিন পর। বললেন কাগজপত্রের কী খবর। বললাম সামনের মাসে ভিজিট শেষ হবে এরপর নতুন কাগজপত্র হবে। ওনার কন্ঠ শুনে বুঝলাম শরীর ভালো নেই। বললেন ভালো লাগছে না, একটু জ্বর হয়েছে। বাসায় খবর নিয়ে জানলাম বাসায় আব্বা আম্মা একা। আমার স্ত্রী সন্তান বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছে। বড় ভাই স্ত্রী সন্তান নিয়ে কুমিল্লা বেড়াতে গেছে। টাকা পয়সার একটু টেনশন ছিলো আব্বার, নিজের টাকা অন্যের কাছে আটকানো এদিকে জুয়েলকে দেয়ার জন্য লাখখানেক টাকা লোন উঠিয়ে দিয়েছিলেন। পেনশনের সামান্য কিছু টাকা দিয়ে ঘর চালাবেন না লোন দিবেন। ১৪ তারিখ সকালে হঠাৎ শুনলাম আব্বা ব্যাংকে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন, হুশ নেই। সিলেট ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে এডমিট করা হয়েছে। অবস্থা খারাপ, আইসিইউ তে ঢোকানো হয়েছে। ঢাকা থেকে আপা, কুমিল্লা থেকে ভাই সরাসরি সিলেট পৌঁছেছে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সারাদিন কেঁদে কেঁদে ডিউটি করলাম। পরের দিন একই অবস্থা, হুশ ফেরেনি। শুনলাম ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। নিজেকে পাগলের মত মনে হলো। দুশ্চিন্তায়, কান্নায় খুব কাহিল হয়ে পড়লাম তবুও ডিউটি করলাম পুরো দিন রাত। এর পরের দিন ১৬ই জুন সকালে শুনলাম ওনাকে নিয়ে আসা হচ্ছে। ডাক্তারদের কিছু করার নেই। আল্লাহ যদি না ফেরান তবে কোনো আশা নেই। জুড়ীতে লোকাল হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হবে। আমি ডিউটিতে যাব এমন সময় শেষ বারের মতো ফোন করলাম, আব্বাকে জুড়ী আধুনিক হাসপাতালে আনা হয়েছে, ডাক্তাররা নাকি পরীক্ষা করে জানিয়েছেন তিনি আর নেই। এখন ছোট ধামাই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের জন্য….
মুহুর্তের মধ্যে আমি ইয়াতিম হয়ে গেলাম। রুমে পড়ে সারাদিন গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদলাম। জুয়েল খবর পেয়ে রুমে এসে সারাদিন শান্তনা দিলো। কলিগ ছোটভাই শাকিল দুপরের খাবার নিয়ে আসলো। সন্ধ্যার মধ্যে আব্বাকে দাফন করা হলো। পরেরদিন থেকে আবার ডিউটি জয়েন করলাম। আমাদের কোম্পানিতে প্রত্যেকের মাসে একদিন মাত্র ছুটি। আমি এখানে আসার পর মাসিক ছুটি বাদে ঐ একদিনই ছুটি করেছি। এর পরের মাসে আমার ভিজিট শেষ হয়েছে। বেতনের কিছু টাকা দিয়ে কয়েকজন এতিম খাইয়েছি ও কোরানে খতম পড়িয়েছি। আমার আবার ভিজিট লাগায় অর্ধেক বেতন দিয়ে পরিবারের জন্য কিছুই করতে পারিনি। জুয়েলকে খবর করে পাইনা। এরপর মাত্র একদিন শপে এসে আমার সাথে কথা বলেছিলো। টেনশন করো না ভিজিটের টাকা আমি দিব। পরে আর আসে নি সে। ফোন, মেসেজের রিপ্লাই পর্যন্ত দেয় না। শুনেছি আজমান ছেড়ে দুবাইয়ে পালিয়েছে সে। এর মাঝে আরো দুজনকে দেশ থেকে এনে একই উপায়ে তাদের টাকা আত্মসাৎ করেছে। আর আমি আমার এত সাধের বাইক, দোকান বিক্রির টাকা ওকে দিয়ে সেই সাথে এত কষ্টের কামাইয়ের টাকা থেকে ওর জন্য তোলা লোনের টাকাটা পর্যন্ত মাসে মাসে দিয়ে চলেছি। এক বছর লাগবে ঐ ঋণ শেষ করতে। এদিকে পরিবারের ভরণপোষণের দায়ীত্ব পালন করেন ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে কবে দেশে এসে মায়ের মুখ দেখতে পারবো জানিনা। যেই ছেলে ভাই ভাই করতো, বাইকটা আধা ঘন্টা নেয়ার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা আমার অফিসে এসে বসে থাকতো। সেই কিনা এত বড় প্রতারণা করলো আমার সাথে! ও আল্লাহ, তোমার কাছে বিচার দিলাম। এই প্রতারক দালাল জুয়েল তালুকদারকে চিনে রাখুন।
লেখক – মেহেদি হাসান ( দুবাই প্রবাসী ও সম্পাদক দৈনিক হাকালুকি)