হাকালুকি হাওরের মৎস্য অভয়াশ্রম ইজারার সিদ্ধান্ত : হুমকির মুখে পড়বে মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:৫৭:৪০,অপরাহ্ন ২৮ আগস্ট ২০১৯
আব্দুর রব :: হাকালুকি হাওরের ২টি মৎস্য অভয়াশ্রম বিল বাতিল করা হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সায়রাত অধিশাখার উপসচিব মো. তাজুল ইসলাম মিয়া ‘বাইয়া’, ‘ উত্তর গজুয়া ও দক্ষিণ গজুয়া’ বিলকে জলমহাল অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন হতে প্রত্যাহার করা হয়। একই দিনে বিলগুলো ইজারা প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন।
এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকিকে ১৯৯৮ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই হাওরকে মিঠাপানির মৎস্য প্রজানন কেন্দ্র বলা হয়। ২০০১ সাল থেকে ২০১৪ হাওর উন্নয়নে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কাজ করলেও গত প্রায় ৫ বছর থেকে হাওরটি অরক্ষিত। নেই হাওর উন্নয়ন পরিকল্পনায়। হাকালুকি হাওর তীরের বড়লেখা উপজেলার বাসিন্দা পরিবেশ বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন মন্ত্রীত্ব পাওয়ার পর হাওর তীরের মানুষ আশায় ছিলেন হাওর উন্নয়ন পরিকল্পনাসহ বিশেষ উন্নয়ন পরিকল্পনার। কিন্তু মানুষের সেই আশা হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে। উন্নয়নতো দুরের কথা বরং উল্টো অভয়াশ্রম বাতিল হওয়ায় হুমকির মুখে পড়বে মৎস্য সম্পদসহ জীববৈচিত্র্য।
জানা গেছে, হাকালুকি হাওরে ২০১০ সালে ৫টি এবং ২০১১ সালে ১২ জলমহালকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ছাড়াও বেসরকারি সংস্থা এই অভয়াশ্রম বাস্তবায়নের কাজ করে। ২০১১ সালে ১২টি জলমহালের মধ্যে শুরুতে ২টি জলমহালকে ইজারা দেয়া হয়। ফলে গত ৭-৮ বছর থেকে ১৫টি জলমহাল অভয়াশ্রম হিসেবে আছে। এসব অভয়াশ্রমের কারণে হাকালুকি হাওরের বিপন্ন প্রজাতির মাছের বংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের উৎপাদনও বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে হাওরের মাছ লুটেরাদের লুলোপ দৃষ্টি পড়ে অভয়াশ্রমগুলোর প্রতি। ঐসব লুটেরাদের ইন্ধনে ২০১৮ সালে বড়লেখা উপজেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় গত ১৪ জুন এবং মৌলভীবাজার জেলা জলমহাল কমিটির সভায় গত ১৪ আগস্ট হাকালুকি হাওরের অভয়াশ্রম ঘোষিত বাইয়া ৮ পৃষ্ঠা ২ কলাম ১ দেখুন
বিল ও উত্তর গজুয়া দক্ষিণ গজুয়া বদ্ধ বিল অভয়াশ্রমকে ইজারা প্রদানের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালেল ০৮ মে মৌলভীবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম অভয়াশ্রম দুটিকে অভয়াশ্রম ঘোষণা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন হতে প্রত্যাহারের চুড়ান্ত চিঠি দেন।
এদিকে মন্ত্রণালয়ে দুটি অভয়াশ্রম ইজারা দেয়ার সুপারিশের খবর জানতে পেরে ২০১৮ সালে ১০ অক্টোবর যধিষ্টিপুর বাদেদৈউলী ইসিএ ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক মো. মরম আলী বিল দুটি ইজারা না দিয়ে অভয়াশ্রম বাস্তবায়নের জন্য আবেদন করেন। এরপর ২৬ নভেম্বর তিনি জেলা প্রশাসক মৌলভীবাজারের কাছে অভয়াশ্রম দু’টি রক্ষার জন্য আবেদন করেন।
এদিকে গত ১১ মার্চ (২০১৯) পরিবেশ অধিদফতরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ইসরাত জাহান পান্না জেলা প্রশাসক মৌলভীবাজারকে অভয়াশ্রম দুটিকে রক্ষার জন্য একটি চিঠি দেন। সেই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, জলাভূমিতে অভয়াশ্রম থাকলে ঐ জলাভূমির উৎপাদন ক্ষমতা ২-৩ গুন বৃদ্ধি পায়। এলাকাবাসি অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনার সুফল পেতে পারে। পাশাপশি হাকালুকি হাওরের পরিবেশ ও প্রতিবেশের অবক্ষয় রোধ হবে এবং হাকালুকি হাওর সম্পদে সমৃদ্ধ হবে। হাকালুকি হাওর এলাকাটি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, মা মাছ সংরক্ষণ ও মাছের অভয়াশ্রম সৃষ্টির জন্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
কুলাউড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার ও বড়লেখা উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সুলতান মাহমুদ জানান, আসলে এধরনের কোন নির্দেশনা এখনো আসেনি। বাস্তবে হাকালুকি হাওরে আরও অভয়াশ্রমের দরকার। অভয়াশ্রম বাতিল হলে মাছ ও জলজ প্রানী অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
জেলা মৎস্য অফিসার মো. এমদাদুল হক জানান, মৎস্য অভয়াশ্রমকে জলমহালের আওতায় দেয়া হোক এটা আমি কখনও চাই না। যারাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা কোনভাবেই সঠিক সিদ্ধান্ত নেননি। এতে শুধু মৎস্য সম্পদেরই ক্ষতি হবে তা না। গোটা ইকো সিস্টেমে এর প্রভাব পড়বে। গত ২৪ আগস্ট জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল হাকালুকি হাওর পরিদর্শন করে গেছে। আশা করি হাকালুকি হাওরে বড় ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হবে, যাতে মৎস্যসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন জানান, তিনি নতুন এসেছেন। ২৭ আগস্ট মঙ্গলবার বড়লেখা উপজেলায় আছেন, বড়লেখার ইউএনও এখনও এ সংক্রান্ত কোন চিঠি পাননি।
এ ব্যাপারে ভুমি মন্ত্রণালয়ের সায়রাত অধিশাখা-১ এর উপসচিব মো. তাজুল ইসলাম মিয়া জানান, আমরা বিল দুটোকে ইজারা দেয়ার আগে ডিসি ও কমিশনারের মতামত চেয়েছি। ওরা তাদের মতামতে বলেছে, এখানে অভয়াশ্রম রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই। পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে পরিবেশ অধিদফতরের কোন ভুমিকা নেই। অভয়াশ্রম বাতিল হলে মাছের উৎপাদন কমবে এবং ইকো সিস্টেমের উপর প্রভাব পড়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমি শুধু স্বাক্ষর করেছি। স্থানীয়ভাবে কিংবা বিল ইজারায় কোন সমস্যার সৃষ্টি হলে এর দায়ভার ডিসিকে নিতে হবে।
সৌজন্যে: দৈনিক জালালাবাদ