ত্যাগের মহিমায় উজ্জল হোক ঈদুল আজহা
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৩৩:১৫,অপরাহ্ন ১২ আগস্ট ২০১৯
আন্তর্জাতিক গ্রেগরিয় পঞ্জিকা বা ইংরেজি বর্ষপঞ্জিতে ঈদের তারিখ প্রতি বছর ভিন্ন হয়। সাধারণত এক বছর থেকে আরেক বছর ১০ বা ১১ দিন করে কমতে থাকে। ঈদের তারিখ স্থানীয়ভাবে জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে।
ইসলামিক ক্যালেন্ডার বা হিজরি বর্ষপঞ্জি হিসাবে জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৩ দিন ধরে ঈদুল আজহার কুরবানী চলে। হিজরি চান্দ্র বছরের গণনা অনুযায়ী ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার মাঝে ২ মাস ১০ দিন ব্যবধান থাকে। দিনের হিসেবে যা সবোর্চ্চ ৭০ দিন হতে পারে।
ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদকে ‘ঈদুজ্জোহা’ নামেও অভিহিত করা হয়। ঈদুল আজহা মূলত আরবি বাক্যাংশ। এর বাংলা অর্থ হলো ‘ত্যাগের উৎসব’। এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ত্যাগ করা, উৎসর্গ করা, কোরবানি করা। এ দিনটিতে মুসলমানেরা ফজরের ফরজ নামাজের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাকায়াত ঈদুল আজহা’র ওয়াজিব নামাজ আদায় করেন ও অব্যবহিত পরে স্ব স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী উট, গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, মহিষ আল্লাহর নামে কোরবানি করেন।
ইসলাম ধর্মের নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, মহান আল্লাহ তা’আলা ইসলামের অন্যতম নবী ও রাসুল, মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আঃ) কে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানি করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি (উৎসর্গ) কর’।
মহান নবী এ আদেশ পেয়ে ১০ টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি আবারো একই আদেশ পেলেন। অতঃপর তিনি এবার ১০০টি উট কোরবানি করেন। এরপরেও তিনি আদেশে পেয়ে ভাবলেন, আমার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন
তিনি পুত্রকে কোরবানির উদ্দেশ্যে প্রস্তুতিসহ আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এ সময় শয়তান আল্লাহর আদেশ পালন করা থেকে বিরত করার জন্য ইবরাহিম ও তার পরিবারকে প্রলুব্ধ করেছিল এবং নবী ইবরাহিম অভিশপ্ত শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলেন। শয়তানকে প্রত্যাখ্যানের কথা স্মরণে হজের আনুষ্ঠানিকতায় শয়তানের অবস্থানের চিহ্ন স্বরূপ নির্মিত ৩টি স্তম্ভে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করা হয়।
অবশেষে হজরত ইবরাহিম (আঃ) যখন আরাফাত পর্বতের উপর তাঁর পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তাঁর পুত্রের পরিবর্তে একটি প্রাণী কোরবানি হয়েছে এবং তাঁর পুত্রের কোন ক্ষতি হয়নি। নবী ইবরাহিম (আঃ) আল্লাহ’র আদেশ পালন করার দ্বারা কঠিন পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হন। এতে সন্তুষ্ট হয়ে মহান আল্লাহ নবী ইবরাহিম (আঃ) কে তার খলিল বা বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেন। যেজন্য এই নবীকে বলা হয় ইবরাহিম খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু।
এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের উম্মতে মোহাম্মদী বা সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারী মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি উদযাপন করেন আল্লাহর নামে পশু কোরবানি বা উৎসর্গ করার মাধ্যমে। অতএব কোরবানির ঈদ হলো আল্লাহর নামে প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করার প্রেরণাদায়ক। আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের অনুপ্রেরণা জাগ্রত করে ঈদুল আজহা।
ঈদুল আজহার কোবরানি প্রদানের মাধ্যমে মুসলমানগণ আল্লাহ আদেশ পালনের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর জন্য সকল ধরনের ত্যাগের শিক্ষা গ্রহণ করেন। কারণ, কোরবানিকৃত পশুর রক্ত ও মাংস আল্লাহর কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়, বিবেচ্য হলো বান্দার তাকওয়া বা খোদাভীতি।
তাই বান্দা আল্লাহর ভয়ে হারাম বা অবৈধকে ত্যাগ করেন এবং হালাল বা বৈধকে গ্রহণ করেন। মজবুত ঈমান রাখার পাশাপাশি নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত, কোরবানি প্রদান করেন। পিতামাতা, প্রতিবেশি, গরীবের প্রতি কর্তব্য পালন করেন এবং সুদ, ঘুষ, জিনা, ব্যাভিচার, জুয়া, মদ্যপান, লোক ঠকানো, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা থেকে বিরত থাকেন।
অনুরূপভাবে কোরবানির মাংসও গরীব এবং প্রতিবেশীদের দিয়ে নিজে আহার করেন প্রতিটি খোদাভীরু মুসলমান। ফলে বিশাল বিশাল গরু ও ষাড় কেনার প্রতিযোগিতা ও উদরপূর্তি করে মাংস ভক্ষণের মাধ্যমে লালসাময় প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করা কোরবানির আদর্শিক চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক এবং কোরবানি কবুল না হওয়ার লক্ষণের প্রতিচ্ছবি।
একইভাবে হারাম উপার্জন ও লোক দেখানো মনোভাবও কোরবানির মূল চেতনা বিরোধী। বরং একমাত্র আল্লাহর জন্য কোরবানি করে সকলকে নিয়ে ও দিয়ে তা পালন ও উপভোগ করাই ইসলামের বিধান। এ বিধান পালনের মাধ্যমে আল্লাহ আদেশের অনুসরণ ও সকলের মুখে হাসি ও মনে খুশি আনা সম্ভব।
ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল ঈদুল আজহা আমাদের সবাইকে আল্লাহ আদেশ পালনে উজ্জীবিত করুক। পরহিত ও মানবকল্যাণে ত্যাগের জন্যেও উদীপ্ত করুক।
সবাইকে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।