সিলেটের রিসোর্টে আটকে ৮ তরুণ-তরুণীর বিয়ে ও অগ্নিসংযোগের নেপথ্যে চাঁদা না দেওয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৪৬:৪৮,অপরাহ্ন ২১ জানুয়ারি ২০২৫
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় রিজেন্ট পার্ক রিসোর্টে আট তরুণ-তরুণীকে আটকের পর কাজী ডেকে বিয়ে ও রিসোর্টে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় একটি পক্ষকে চাঁদা না দেওয়ার ঘটনা।
সোমবার (২০ জানুয়ারি) বিকালে রিসোর্টের মালিক হেলাল উদ্দিন অভিযোগ করেছেন, গত ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর একটি পক্ষ তার কাছে একাধিকবার চাঁদা চাইতে এসেছিল। ওই পক্ষটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। কয়েক দফায় চাঁদা চাওয়ার পরও না পাওয়ায় এমন ঘটনা ঘটিয়েছে তারা।
রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল উদ্দিন সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়েছে। এতে আমাদের রিসোর্টের প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া কিছু মালামাল নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। সেইসঙ্গে রিসোর্টে আগত অতিথিদের তালিকাতেও আগুন দেওয়া হয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে তারা।’
ওই রাজনৈতিক দলের নেতারা কারা জানতে চাইলে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘এখানের সবাই তাদের চেনেন এবং জানেন। আমি কারও নাম বলতে চাই না। সুনামের সঙ্গে সাড়ে ১১ বছর ধরে ব্যবসা করে যাচ্ছি। সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক পক্ষটি একাধিকবার চাঁদা চেয়েছিল। না দেওয়ায় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
চাঁদা দাবির কথা পুলিশকে জানিয়ে ছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে ব্যবসা করতে আসছি। প্রভাবশালীদের ভয়ে পুলিশের কাছে যাইনি। গেলেও কি খুব উপকার হতো? ক্ষতি আরও বেশি হতো।’
হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘হামলার পর রবিবার রাতে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বৈঠক হয়। তারা রিসোর্টের মূল ফটকে তালা দিয়ে চাবি নিয়ে যান। পকেট গেটের তালার চাবি রেখে যান তারা।’
এর আগে রবিবার দুপুরে রিজেন্ট পার্ক রিসোর্টে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ তুলে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন দক্ষিণ সুরমার সিলাম এলাকার লোকজন। এ সময় রিসোর্টে অবস্থান করা ১৬ তরুণ-তরুণীকে আটক করেন তারা। পরে ওই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আট জনকে অভিভাবক ডেকে বিয়ে দেন। অন্যদের অভিভাবকদের জিম্মায় সামাজিকভাবে বিয়ের আয়োজন করার মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেন।
ওই দিন রাত ১০টার দিকে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল উদ্দিন। এ সময় স্থানীয় লোকজন রিসোর্টের মূল ফটকে তালা দিয়ে চাবি নিয়ে যান। পকেট গেটের তালার চাবি মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আরও কয়েকদিন পর এ বিষয়ে স্থানীয় লোকজন আবার মালিকের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে জানিয়ে দিয়ে যান।
স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিণ সুরমার সিলাম এলাকার রিজেন্ট পার্কে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে স্থানীয়রা রবিবার দুপুরে পার্কে প্রবেশ করেন। এ সময় পার্ক ও রিসোর্টের কক্ষে অবস্থান করা ১৬ তরুণ-তরুণীকে আটক করেন তারা। স্থানীয় লোকজন পার্কের বিভিন্ন আসবাব ও দরজা-জানালা ভাঙচুর করেন। একপর্যায়ে রিসোর্টের একটি অংশে আগুন ধরিয়ে দেন। আগুনের খবর পেয়ে দক্ষিণ সুরমার ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ও মোগলাবাজার থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী সরকারের আমলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং পুলিশকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে রিসোর্ট চালিয়ে আসছিল কর্তৃপক্ষ। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে বিএনপি দাবিদার একাধিক গ্রুপ রিসোর্টের দিকে দৃষ্টি দেয়। এতে মালিকপক্ষ বিপাকে পড়ে। কোন পক্ষকে চাঁদা দেবে, তা ঠিক করতে পারেনি। ফলে কোনও পক্ষেরই মন রাখতে পারেনি মালিকপক্ষ। এর মধ্যে একটি পক্ষ ক্ষেপে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে।
হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘স্থানীয় বাসিন্দা পরিচয়ে বিভিন্ন আয়োজনে রিসোর্ট ভাড়া নিতেন কয়েকজন। কিন্তু টাকাপয়সা ঠিকমতো দিতেন না। ৫ আগস্টের পর চাঁদা দাবিকারীরা বলতেন, আমরা ভালো ব্যবসা করছি, তাদের যাতে ব্যবসায় অংশীদার করি। চাঁদা দাবি করা ব্যক্তিরা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে নিরাপত্তার স্বার্থে রিসোর্টের মূল ফটকে তালা দিয়ে এলাকার মুরুব্বিদের কাছে চাবি রাখা হয়েছে। ছোট গেটের চাবি মালিককে দেওয়া হয়েছে। কয়েকদিন পর আরও একটি বৈঠক করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পাত্রপাত্রী ও দুই পরিবারের অভিভাবকদের সম্মতিতেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। চারটি বিয়ের মধ্যে তিনটি ১০ লাখ টাকার কাবিন এবং একটির ১২ লাখ টাকার কাবিন করা হয়েছে।’
মালিকপক্ষের অভিযোগের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় কেউ মালামাল নিয়ে যাননি। যেটি অভিযোগ করা হচ্ছে, টাকাপয়সা চাওয়া হয়েছে, নাম-পরিচয় প্রকাশ করলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মহানগর পুলিশের মোগলাবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন তাহলে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন। থানায় অভিযোগ দাখিল করলে পুলিশ তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবে। তবে এখন পর্যন্ত রিসোর্টের বিষয় নিয়ে থানায় কেউ অভিযোগ করেননি।
বিয়ে দেওয়া এক ছেলের অভিভাবক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে মানসম্মান বড় বিষয়। তাই কোনও কিছু না ভেবে তাদের সব শর্ত মেনে সন্তানকে বিয়ে করাতে বাধ্য হয়েছি।’