কুলাউড়ায় মনু বাঁধের তিন স্থানে ভাঙ্গন, পানিবন্দি সহস্রাধিক পরিবার, উপজেলা প্রশাসনের সাথে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে সেনাবাহিনী
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৩১:২১,অপরাহ্ন ২২ আগস্ট ২০২৪
কুলাউড়া প্রতিনিধি :: কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নে বুধবার মধ্যরাতে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ মিয়ারপাড়া এলাকায় প্রায় ছয়শত ফুট ও সকাল সাতটায় চক সালনে প্রায় দেড়শত ফুট এলাকা জুড়ে বিশাল ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার মধ্যরাতে ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামে প্রায় সাতশত ফুট এলাকা জুড়ে বিশাল ভাঙ্গন দেখা দেয়। ভাঙ্গনের কারণে পুরো ইউনিয়নে পানি ঢুকে পড়েছে। ইউনিয়নের ভেতর শমসেরনগর-ব্রাহ্মণবাজার প্রধান সড়কের বিভিন্ন স্থানে হাঁটুপানি থাকায় সবধরণের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এদিকে পানিবন্দি মানুষ যারা বাড়িতে আটকা পড়েছে তাদের উদ্ধারে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, স্কাউটস, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা।
সরেজমিনে টিলাগাঁও ইউনিয়নের মিয়ারপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৬০০ ফুট বিশাল জায়গা জুড়ে ঝুঁকিপূর্ন নদী প্রতিরক্ষা বাঁধটি বুধবার মধ্যরাতে ভেঙে যায়। গত দুইদিন ওই বাঁধটি রক্ষায় স্থানীয় ৪ শতাধিক লোকজন বালুর বস্তা ফেলে প্রাণপণ চেষ্টা চালালেও শেষমেশ রক্ষা করা যায়নি বাঁধটি৷ বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় পুরো টিলাগাঁও ইউনিয়নের প্রায় সবক’টি এলাকায় পানি প্রবেশ করে। ওইসব এলাকার অনেক লোকজন নিরাপদ স্থানে যেতে পারেননি। নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য লোকজন ছুটাছুটি করছেন। তাদের উদ্ধারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো : মহি উদ্দিনের নেতৃত্বে ফায়ার সার্ভিস, জনপ্রতিনিধি, স্কাউটসসহ একটি দল কাজ করছে৷ অন্যদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কুলাউড়া ক্যাম্পের একটি টিম দুর্গত মানুষদের উদ্ধারে কাজ করছে।
এদিকে টিলাগাঁও ইউনিয়নের আশ্রয়গ্রাম, লালবাগ, সন্দ্রাবাজ ও খন্দকারের গ্রাম, পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়া, ছৈদলবাজার, বেলেরতল এবং হাজিপুর ইউনিয়নের মন্দিরা, দাউদপুর, চক রনচাপ ও কাউকাপন বাজার এলাকায় মনু নদীর পানি প্রতিরক্ষা বাঁধ ঝুকিপূঁর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব স্থানে যেকোন সময় ভাঙন সৃষ্টি হতে পারে। গত তিনদিন থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় লোকজনের উদ্যোগে বালির বস্তা দিয়ে ভাঙন ঠেকাতে প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে করা হয়।
হাজিপুর ও মিয়ারপাড়া গ্রামে মনু নদীতে সৃষ্ট ভাঙন এলাকা পরির্দশনে গেলে ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জুনাব আলী জানান, বুধবার রাত ১২ টা ৫০ মিনিটে ঝুঁকিপূর্ণ মিয়ারপাড়া বাঁধটি মনু নদীর পানির স্রোতে ভেঙে যায়। এতে আমার ওয়ার্ড পুরোটাই প্লাবিত হয়। অনেক ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অনেক লোকজন রাতে নিরাপদে অন্যত্র আশ্রয় নেন, কিছু লোক নদীর বাঁধের উপর রয়েছেন আবার কিছু লোক ঘরের ছাদে আশ্রয় নিয়েছেন। এরআগে মঙ্গলবার বিকাল থেকে মনু নদীর পানি গুদামঘাট (হাজিপুর) এলাকায় প্রতিরক্ষা বাঁধের উপর দিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছিলো। সৃষ্ট ভাঙনের ফলে টিলাগাঁও ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডসহ কয়েকটি ওয়ার্ডে প্রায় সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দি রয়েছেন। এছাড়া ৫ শতাধিক ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
টিলাগাঁও ইউপির মিয়ারপাড়া গ্রামের আসুক মিয়া জানান, বাঁধের নিচে আমার পাকার ঘর ছিল। নদীর ভাঙ্গনে আমার ঘরটি পানির স্রোতে পুরোটা ভেঙে নিয়ে যায়। ঘরের কোন জিনিসপত্র বের করতে পারিনি। ৯ সদস্যদের সংসারে কিছু সদস্য আমার আত্মীয়য়ের বাড়িতে আর কিছু সদস্য বাঁধের উপরে আশ্রয় নিয়েছেন।
হাজীপুর গ্রামের কনাই মিয়া, পারভেজ মিয়া, জলাল মিয়া, ফয়জু মিয়া, ইন্তাজ মিয়া, ইন্তু মিয়া, বাতির মিয়া বলেন, মনু নদীর ভেঙ্গে গেলে আমাদের ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আমরা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি।
এদিকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মহি উদ্দিন, সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদুল আহসান, মেজর রিয়াদ, ক্যাপ্টেন আদনান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহ মুহাম্মদ জহরুল হোসেন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. শিমুল আলী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো: মহসিন, টিলাগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: আব্দুল মালিক সরেজমিন ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে দুর্গত মানুষের খোঁজখবর নেন।
টিলাগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক জানান, দুইদিনে আমার ইউনিয়নের তিনটি স্থানে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সংখ্যা এখনো সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সেই ত্রাণ পরিষদের সদস্যসহ স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতায় দুর্গত মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. শিমুল আলী জানান, তাৎক্ষণিকভাবে ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষের জন্য শুকনো খাবার ও ১০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পানি কমার পর ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা প্রস্তুত করা হবে। আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়া যেসব লোকজন তাদের বাড়ি ছেড়ে আসতে চাচ্ছেন না তাদের বাড়িতে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: মহি উদ্দিন বৃহস্পতিবার বিকেলে জানান, টিলাগাঁও ইউনিয়নের মিয়ারপাড়া, হাজীপুর ও চক সালন এলাকায় ভাঙ্গনের খবর পাওয়ার সাথে সাথে ফায়ার সার্ভিস, স্কাউটসের একটি টিমসহ আমরা ছুঁটে যাই। হাওর এলাকা থেকে একটি নৌকা ব্যবস্থা করে ভাঙ্গন কবলিত মিয়ারপাড়াসহ অন্য এলাকা থেকে থেকে প্রায় ৪০ টি পরিবারের দেড় থেকে দুই শতাধিক লোকদের উদ্ধার করে নিরাপদস্থানে নেয়া হয়েছে। আমাদের সাথে সেনাবাহিনীর একটি টিম পানিবন্দিদের উদ্ধারে নৌকা নিয়ে কাজ করছে। এছাড়া দুর্গত মানুষের জন্য বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে৷ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি।