৬০ টি খুন,এক বরফকল ও এরশাদ শিকদার
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:৫১:৪২,অপরাহ্ন ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
আসাদুর রহমান তারেক :: বাংলাদেশের ইতিহাসে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার হিসেবে প্রথমেই হয়তো উঠে আসবে এরশাদ শিকদারের নাম। ৬০টির মত খুন করেছেন তিনি। প্রতিটিতেই ছিল বর্বরতা ও নাটকীয়।
এরশাদ শিকদারের জন্ম হয় ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মাদাঘোনা গ্রামে। পিতা দরিদ্র কৃষক আর মা কাজ করতেন মানুষের বাড়িতে। ১৯৬৬-১৯৬৭ সালে চলে আসেন খুলনায়। খুলনায় আসার পর কাজ করতেন কুলি হিসেবে।তবে কাজের চেয়ে বেশি চুরির অভ্যাসই পেয়ে বসে তাকে। গায়ের রং ফর্সা হওয়ায় নাম হয়ে যায় “রাঙা চোর”! ১৯৭৬-১৯৭৭ এ এরশাদের সাথী হয় রামদা। তৈরী করে ফেলেন একটি দল।
শুরু হয় বার্জ-কার্গো চুরি,কাঠ চুরি, রেল লাইনের স্লিপার চুরি। একে একে যোগ হয় ছিনতাই ও ডাকাতি, জোরপূর্বক মানুষের সহায়-সম্পত্তি দখল করা।আশির দশকের শেষের দিকে এরশাদের ক্ষমতা বেড়ে যায়। খুলনায় মদ, গাজা, হিরোইন, ফেনসিডিলের ব্যবসা শুরু করেন। হয়ে উঠেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক।
১৯৮৮ সালে পেয়ে যান প্রশাসনিক ক্ষমতাও। দখল করে নেন বিমান ও রেলের জায়গা, গড়ে তুলেন বস্তি। হাজার হাজার মানুষ বসবাস শুরু করে, এর মধ্যে অনেকেই জড়িয়ে যায় তার অনৈতিক কর্মকান্ডে। দক্ষিনাঞ্চলের অপরাধ জগতে আধিপত্য ছিলো এরশাদের। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তার বর্বরতা ও সহিংসতা।
১৯৯১ সালে এরশাদের দখলে আসে একটি বরফকল। পরবর্তীতে এই বরফকল হয়ে যায় একটি ত্রাসের নাম! পৈচাশিক নির্জাতন, ভয়াল চিৎকার – আর্তনাদ ও নির্মম মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে থাকে এই বরফকল।
এরশাদ শিকদারের খুন করার একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ছিল। বন্দির উপর চালানো হতো ভয়াবহ নির্যাতন। পা চেপে ধরা হতো, পিটানো হতো পায়ে যতক্ষণ না পায়ের হাড় গুড়ো গুড়ো না হয়ে যেত। গলায় পেচানো হতো দড়ি। শ্বাসরোধ করে মারা হতো, মৃত্যর পরও থামতো না পৈচাশিকতা!এরশাদ উঠে যেতেন লাশের বুকে। লাফানো শুরু করেতেন, পাজঁরের হাড় ভাঙার পর থামতো এই অবর্ণনীয় উন্মাদনা। এরপর লাশ সিমেন্টের বস্তায় বেধে ফেলে দেওয়া হতো ভৈরব নদীতে। সবশেষে এরশাদ গোসল করতেন এক বালতি দুধ দিয়ে “পবিত্র” হওয়ার জন্য!একটু চিন্তা করে দেখুন কতটা ঠান্ডা মাথায় এবং নাটকীয়ভাবে এরশাদ শিকদার চালিয়ে গেছেন তার হত্যাকান্ড। এ যেন ভয়ংকর সিনেমার স্ক্রিপ্টকেও হার মানায়।তার এই রক্তের তান্ডব ও বর্বরতা চলতেই থাকে ক্রমেই ভৈরব নদী হয়ে উঠে লাশের নদী।
বরফকলের পাশাপাশি খুলনার কয়েক জায়গায় তিনি গড়ে তুলেন অত্যাচার ক্যাম্প। ১০-১২ ফিটের একটি পুল তৈরি করেন, চাষ করেন রক্তপিপাসু আফ্রিকান মাগুর। কথিত আছে মাঝে মাঝে মানুষ ফেলে দেওয়া হতো এখানে। মাছেরা চিড়ে টুকরে খেত লাশ। ভেসে আাসত কেবল হাড় গোড়।
১৯৯৫ সালে এরশাদের সম্পদের পরিমান হয়ে যায় ১০০ কোটি টাকার। অন্য সব অপরাধের সাথে সুদের ব্যাবসাও নাকি জুটিয়ে ছিলেন। স্বর্ণকমল নামক বিলাসবহুল এক বাড়িও তৈরী করেন। তৎকালীন সময়ে খুলনার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দিত বাড়ি বলা হতো স্বর্ণকমলকে। ভারত থেকে নকশা করে আনা হয় এই বাড়ির। কথিত আছে নির্ধারিত জমি থেকে মাত্র এক ইঞ্চি এদিক ওদিক হওয়ায় প্রাণ দিতে হয় বাড়ি নির্মাণের দ্বায়িত্বে থাকা লোকটিকে!
এরশাদ শিকদারের মরণ ছোবলে পড়েন ৬০ জন মানুষ তাও এ তথ্য কেবল পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী। এর বাইরে আরও কতো মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছে তার হিসেব নেই। মৃত ব্যাক্তিদের মধ্যে রয়েছে রুপসার যুবলীগ কর্মী খালিদ, দৌলতপুরের অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির ফটিক, সোনাডাঙ্গার ইনসাফ, কামাল,খালেক,সোনাহাটির টাক আজিজ ও প্রমুখ। রক্তের খেলা জমানো এই সিরিয়াল কিলারের প্রিয় একটি গান ছিল “আমি তো মরেই যাব, চলে যাব, রেখে যাব সবই!” প্রিয় এই গানের মত তার পরিনতি ও হয়েছিল একই।
১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে গ্রেফতার হন তিনি। এক সময়ের ডান হাত নুরে আলমই আদালতের রাজসাক্ষী হন। ২৪টি খুনের বর্ণনা দেন। এই নুরে আলমের স্ত্রীর উপর ও নির্যাতন চালাতেন এরশাদ। সবকিছু জেনেও তখন চুপ থাকতে হত নুরে আলমকে! তবে আদালতে সে সাক্ষী দিয়েছে ঠিকই এরশাদের বিরুদ্ধে। বলেছে ভয়ংকর সব খুনের কাহিনী। তার ভাষ্য থেকে বেড়িয়ে এসেছে অজানা অনেক তথ্য।
১৭টি খুনের মামলায় ৬টি তে ফাঁসি ও ৫টি তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। মৃত্যুর আগে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষাও চান কিন্তু লাভ হয়নি কোন। শোনা যায় ৬টি স্ত্রী রয়েছিল তার। মৃত্যুর আগে আত্মীয় স্বজনদের বকাঝকা ও করেছেন কেন তার সম্পত্তির জোরে তাকে ছুটিয়ে নেয়া হচ্ছে না তাই। এরশাদ ভেবেই ছিলেন সে পার পেয়ে যাবে, কিন্তু শেষ অবধি তা হয়নি। ২০০৪ সালের ১০ মে ১২ টা ০১ মিনিটে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মৃত্যু হয় ভয়াল সে সিরিয়াল কিলারের। টুটপাড়া কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।