সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু: এখনই সাবধান না হলে ঘনিয়ে আসতে পারে বিপদ
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:০৬:২৭,অপরাহ্ন ২৮ জুলাই ২০১৯
নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে ডেঙ্গু। এডিস মশা দ্বারা আক্রান্ত এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। আতঙ্ক বিরাজ করছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, যশোর, ঝিনাইদহ, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় একাধিক ডেঙ্গুরোগী পাওয়া গেছে। এখনই সাবধান না হলে ঘনিয়ে আসতে পারে বিপদ।
ডেঙ্গুর বিষয়টি মানুষ জানলেও এর যে গতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন হচ্ছে, সে সম্পর্কে সচেতনতা নেই অনেকের। অনেক চিকিৎসকেরও এ বিষয়ে ভালো ধারণা নেই। কাজেই সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।
এডিস ইজিপটি নামের মশার কামড়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস মানব শরীরে প্রবেশ করে। এ মশা ভাইরাসবাহী কাউকে কামড়ানোর পর অন্য আরেকজনকে কামড়ালে সেই মানুষটি আক্রান্ত হয়। এডিস মশা স্থির পানিতে, যেমন- পরিত্যক্ত টায়ার, পানির বোতল, কনটেইনার, ফুলের টব, এয়ারকুলারের পানি ইত্যাদির মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে।
সাধারণত শহরাঞ্চলে রোগটি বেশি হয়, তুলনামূলকভাবে গ্রামে কম হয়। এক রোগী থেকে অন্য মানুষের শরীরে সরাসরি ডেঙ্গু ছড়াতে পারে না। তাই রোগীর সংস্পর্শে গেলেই ডেঙ্গুও হয় না।
ডেঙ্গু রোগের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে : ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। সাধারণত একবার এক সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হলে পরবর্তী সময় আরেকটি দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কারও হয়তো ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে, কিন্তু ঠিক কোন্ টাইপের ডেঙ্গু তা শনাক্ত করা হচ্ছে না।
কাজেই ডেঙ্গু পরীক্ষার পাশাপাশি টাইপিং বের করাটাও জরুরি। না হলে রোগীকে সঠিক চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রকারভেদ : ডেঙ্গু ক্লাসিক্যাল, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম- এ কয়েক ধরনের ডেঙ্গু হয়। ক্লাসিক্যাল বা সাধারণ ডেঙ্গুতে প্রচণ্ড জ্বর হয়, যা ১০৪ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। জ্বর দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
সঙ্গে মাথাব্যথা, পেটব্যথা, বমি বমি ভাব, চোখের পেছনে ব্যথা, মাংসপেশি বা গিঁটে ব্যথা, শরীরে র্যাশ থাকতে পারে। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু হলে তেমন সমস্যা নেই, এতে মৃত্যুর মতো ঘটনা সাধারণত ঘটে না।
ডেঙ্গু হেমোরেজিকে জ্বর কমে যাওয়ার দু-তিন দিনের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাল লাল র্যাশ বা রক্তবিন্দুর মতো দাগ দেখা যায়। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে মাড়ি বা নাক দিয়ে আপনা-আপনি রক্তক্ষরণ, রক্তবমি, কালো রঙের পায়খানা, ফুসফুসে বা পেটে পানি জমা ইত্যাদি।
রক্ত পরীক্ষা করালে দেখা যায়, রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেটের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি বেশি, যাতে শরীর থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে পারে।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের উপসর্গগুলোর পাশাপাশি রোগীর রক্তচাপ হঠাৎ কমে যায়, নাড়ির গতি বৃদ্ধি পায়, হাত-পা শীতল হয়ে আসে, রোগী নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এমনকি রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের জ্বর হলে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া উচিত। অনেক সময় চিকিৎসকের পরামর্শে রক্ত বা অণুচক্রিকাও দিতে হতে পারে। তবে সবার যে এমন হবে, তা কিন্তু নয়।
জ্বর হলে করণীয় : ১. যে কোনো জ্বরে আক্রান্ত রোগী যত বেশি বিশ্রামে থাকবে, যত বেশি তরল খাবার খাবে, তত দ্রুত জ্বর নিয়ন্ত্রণে আসবে। তাই ডেঙ্গুর মূল চিকিৎসা প্রচুর তরল বা পানি গ্রহণ করা, পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকা ইত্যাদি।
২. যে কোনো জ্বরে ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপর তাপমাত্রা গেলেই তা কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে সাপোজিটর ব্যবহার করতে হবে।
৩. প্রচুর পানি, শরবত ও তরল খাবার বেশি দিতে হবে। কোনো অবস্থায়ই শরীরে যেন তরলের ঘাটতি না হয়।
৪. জ্বর হলে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাবেন না। অন্যান্য ওষুধ প্রয়োগ না করাই উচিত। তবে যে কোনো জ্বর তিন দিনের বেশি থাকলে, শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এতে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই।
৫. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ সেবন নয়। কেননা হেমোরেজিক ডেঙ্গু হলে কিছু ব্যথার ওষুধ রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে বিপদ ঘটাতে পারে। ৬. তীব্র জ্বরের সঙ্গে শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে।
৭. মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু কোনো মারাত্মক রোগ নয় এবং এতে চিন্তার কিছু নেই। এই রোগ নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়, এমনকি কোনো চিকিৎসা না করালেও। তবে মারাত্মক জটিলতা এড়াতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উচিত।
৮. জ্বর কমে যাওয়ার পরের কিছু দিনকে বলা হয় ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড। এ সময়টায় সবার সচেতন থাকা খুব জরুরি। ৯. ডেঙ্গু নিয়ে অহেতুক ভয় নেই। সাধারণ ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি ১ শতাংশের কম।
কখন হাসপাতালে : ডেঙ্গুর চিকিৎসা বাড়িতেও সম্ভব, তবে রোগী বেশি দুর্বল ও পানিশূন্য হয়ে পড়লে বা শরীরের কোথাও রক্তবিন্দুর মতো দাগ, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, নাক বা মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার মতো যে কোনো লক্ষণে দেরি না করে হাসপাতালে নিতে হবে।
ডেঙ্গু আক্রান্তদের কারও পেটব্যথা বা ডায়রিয়া হলে সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত। ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে দ্বিতীয়বার আক্রান্তরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। তাই সঙ্গে সঙ্গেই তাদের হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা দেয়া উচিত।
মায়োকার্ডিটিসে ভয় : এখনকার ডেঙ্গু রোগের প্রকৃতি ও ধরন অনেকটা বদলে গেছে। ডেঙ্গু হলে অনেকের হার্ট, লিভার ও কিডনি আক্রান্ত হচ্ছে। নতুন আতঙ্ক হয়ে সামনে এসেছে মায়োকার্ডিটিস বা হৃদযন্ত্রের প্রদাহ।
ডেঙ্গু হলে সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা না নিলে হৃৎপিণ্ডের পেশির প্রদাহ বা মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। ডেঙ্গুর কারণে মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হওয়া খুবই বিপজ্জনক। এটি প্রায়ই ভাইরাল সংক্রমণের কারণে হলেও অনেক চিকিৎসকের পক্ষে তা দ্রুত বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে।
মায়োকার্ডিটিসের সাধারণ লক্ষণগুলো হল- শ্বাস-প্রশ্বাসের হ্রস্বতা, বুকে ব্যথা, ব্যায়াম করার ক্ষমতা হ্রাস, অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন ইত্যাদি।
এখন ডেঙ্গুজ্বরের মৌসুম। এ সময়ে জ্বরে আক্রান্ত হলে ডেঙ্গুর বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। তাই সাধারণ জ্বর হলেও ২-৩ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে ডেঙ্গু হয়েছে কিনা। কোনো অবহেলা করা যাবে না। কোনো রকম অবহেলা করলে ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসতে পারে।
লেখক:সাবেক ডিন, মেডিসিন অনুষদ; সাবেক চেয়ারম্যান, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।